হঠাৎ করেই জাতীয় দলের একেবারেই বাইরে! এক সময় জাতীয় দলের নাম্বার ওয়ান পেস বোলার। আবার অধিনায়কও। সেই জাহানারা নীরবে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল।
কিন্তু উত্তর নেই। পারফরমেন্স করতে পারছেনা, তো দল থেকে সরে গেছে। আর পারফরমেন্স ঠিক আছে কি না তার মাপকাঠি অনেকটাই বিসিবি’র সংশিলিষ্টদের হাতেই ছিল। ফলে ভেতরটা ওভাবে আর জানা যায়নি। কিন্তু এখন জাহানারা আলম জানাচ্ছেন, একটি মহল তার ক্যারিয়ারটা শেষ করে দিয়েছে। ফলে ক্রিকেট থেকে একটু দূরেই এখন তিনি। কিন্তু জাতীয় দলে থাকাকালীন সময়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে জাহানারা আলমকে। সে সূত্রেই মুখ খুলছেনে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় দলে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব না বলা কথা সামনে এনেছিলেন পেসার জাহানারা আলম। এবার যৌন হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগ তুললেন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করা ওমেন্স ন্যাশনাল টিমের সাবেক এই পেসার।
ইন্টারভিউ দেয়া কালীন সময়/ছবি সংগৃহীত
যেখানে সাবেক নির্বাচক, সাবেক ইনচার্জ, ম্যানেজারসহ বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়েও অভিযোগ তোলেন জাহানারা। এদিকে জাহানারা আলমের এ খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়া তোলপাড়। এএফপি, বিসিবি, দ্যা হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া, জি নিউজ, ডন,, ক্রিক ট্রাকার, ক্রিকবাজ সহ বহু আন্তর্জাতিক মি-ডিয়া গুরুত্বের সঙ্গে খবর পরিবেশন করেছে। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ক্রিকেট ও বিসিবি চরম ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে।
দেশজুড়েও এ নিয়ে তোলপাড়। যেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা বেশীরভাগ উঠে আসে রক্ষনশীল ফ্যামেলী থেকে। সেখানে মেয়েদের ক্রিকেট খেলতে দিতে এখন অনেকেই সাতবার চিন্তা করবে। এতে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেট হুমকির মধ্যে পড়ে গেল।

জাতীয় দলের ম্যাচে জাহানারা/ছবি সংগৃহীত
ঘটনায় উঠে এসেছে যা
বৃহস্পতিবার একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে জাহানারা ইসলাম বলেন, ‘উনি (মনজুরুল ইসলাম) একদিন আমার কাছে আসলেন, আমার কাঁধে হাত রেখে বলছিলেন, তোর পিরিয়ডের কতদিন চলছে। পিরিয়ড শেষ হলে বলিস, আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। পিরিয়ড শেষ হলে, যখন ডাকবো চলে আসিস।’
মনজুরুলকে নিয়ে অন্য এক অভিযোগে জাহ-
নোরা বলেন, ‘বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচে যখন আমরা লাইনে হ্যান্ডশেক করি, তখন তিনি (মনজুরুল) হ্যান্ডশেক না করে জড়িয়ে ধরতেন।’
জাহানারার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বার্তা সংস্থা এএফপিকে বর্তমানে চীনে অবস্থানরত মনজুরুল বলেন, ‘সব মিথ্যা। আপনি দলের অন্য মেয়েদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন’
মঞ্জুর অস্বীকার
তবে এসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন মনজুরুল। জাহানারার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বার্তা সংস্থা এএফপিকে বর্তমানে চীনে অবস্থানরত মনজুরুল বলেন, ‘সব মিথ্যা। আপনি দলের অন্য মেয়েদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন।’ ক্রিকেটার জাহানারা আলম স্পষ্ট করে বলেছেন, মঞ্জুরুল ইসলাম ও নারী বিভাগের সাবেক ইনচার্জ প্রয়াত তৌহিদ মাহমুদ তাকে যৌন হয়রানি করেছেন। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই মঞ্জুরুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
শুক্রবার (৭ নভেম্বর) রাতে এ প্রসঙ্গে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে জাতীয় দলের সাবেক এই বাঁহাতি পেসার লেখেন, ‘বৃহস্পতিবার একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নারী দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম আমার বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। এরপর থেকে দেশ-বিদেশের সাংবাদিক ভাই-বোনেরা থেকে শুরু করে শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই আমার বক্তব্য জানার চেষ্টা করছেন; যোগাযোগ করছেন। এ বিষয়ে আমার নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।’
মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগের পর বিসিবি জেনেছে, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সেই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। বিসিবি ছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি কোনও তদন্ত কমিটি গঠন হয়, আমি সেগুলোও মোকাবিলা করবো এবং আমার বক্তব্য তুলে ধরবো। এর আগে আমি এ বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকছি।’
এছাড়া তিনি আরও যোগ করেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রকৃত সত্য সবার সামনে আসবে আশা করছি। সে সময় পর্যন্ত অনুমাননির্ভর কোনও তথ্য প্রকাশ না করার জন্য সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করছি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমি সবার সঙ্গে কথা বলবো।’
ক্রীড়া উপদেষ্টা যা বললেন
শুক্রবার জাহানারার সেই অভিযোগ নিয়ে গতকাল কথা বলেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গণমাধ্যমকে আসিফ বলেন, ‘আমাদের দপ্তর থেকেও ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি যদি আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, যেহেতু এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’ যৌন হয়রানির ঘটনা ক্রীড়াঙ্গনের জন্য বড় হুমকি বলে মন্তব্য করেন ক্রীড়া উপদেষ্টা, ‘এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়।
খেলাধুলার অন্যান্য ক্ষেত্রেও বহুবার শুনেছি। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ এ ধরনের কাজ করে পার না পেয়ে যায়।’
তামিম ইকবাল যা বললেন
পেসার জাহানারা আলম ইস্যুতে এবার সরব হলেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। টাইগ্রেস পেসারের ঘটনায় বিসিবির বাইরে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন এবং আরও এমন ভুক্তভোগীদের সাহস নিয়ে সামনে আসার বার্তা দিয়েছেন তিনি।
গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে তামিম লিখেছেন, জাহানারা আলম যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, সবগুলোই গুরুতর এবং সেসব সত্যি হলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। শুধু একজন জাতীয় ক্রিকেটার বা সাবেক অধিনায়ক বলেই নয়, যে কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটার হোক বা যে কোনো খেলার ক্রীড়াবিদ কিংবা যে কোনো নারী, কারো প্রতিই এমন আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাকটিসে জাহানারা আলম/ছবি সংগৃহীত
বিসিবি প্রথম পাত্তা না দিলেও পরে ব্যবস্থা গ্রহনে উদ্যোগ
জাহানারা আলমের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় পড়ে যায় দেশের ক্রিকেট আঙিনায় ও সামাজিক মাধ্যমে। পরেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিবৃতি দিয়ে বিসিবি জানায়, ‘স্পর্শকাতর’ এই অভিযোগগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে যারা তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ জানাবে। সব ক্রিকেটার ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নিরাপদ,
সম্মানজনক ও পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিসিবি নিবেদিত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে। এই ধরনের ব্যাপারগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া ও তদন্তের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানায় বোর্ড।
কয়েকদিন আগে দৈনিক কালের কণ্ঠকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জাহানারা গুরুতর কিছু অভিযোগ করেছিলেন নারী দলের ভেতরের নানা কিছু ও ড্রেসিং রুমের পরিবেশ নিয়ে। অধিনায়ক নিগার সুলতানাকে কাঠগড়ায় তোলেন তিনি দলে আধিপত্য বিস্তার, সিন্ডিকেট তৈরি, ক্রিকেটারদের মারধর করা, জুনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করাসহ নানা অভিযোগে। এছাড়াও সহ-অধিনায়ক নাহিদা আক্তার, সিনিয়র ক্রিকেটার ফারজানা হক ও রিতু মনির দিকেও একই ধরনের অভিযোগ তিনি তোলেন।
পরে রিয়াসাদ আজিমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও জাহানারা এক পর্যায়ে বলেন, নিগার-নাহিদা ফারজানা-রিতুদের তিনি কখনও ক্ষমা করবেন না। তবে তিনি এ কথাও বলেন, যে বারবার এ ব্যাপারে বিসিবিতে অভিযোগ দিয়েও নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বাধীন বিসিবির প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ গ্রহন করেনি।
বিসিবি অবশ্য সেসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও সত্য-বিবর্জিত’ বলে উড়িয়ে দেয়। বিসিবির নারী বিভাগের নতুন প্রধান আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বাইরের মানুষ’ জাহাানারার কথাকে তারা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। উল্লেখ্য, জাহানারাই প্রথম যিনি সেক্সুয়াল হ্যারেসম্যান্টের অভিযোগ তুললেন। কিন্তু নারী ক্রিকেট দল গঠন হওয়া থেকে এ পর্যন্ত আরো কোনো ঘটনা আছে কিনা সেটা এখন খুজে বের করবে কে? কারন সামাজিক ও অন্যান্য কারনে বাংলাদেশের অনেক নারী সাধারনত মুখ খুলতে চান না।